Tuesday, March 8, 2011

চোরের শাস্তি।(শেষ অংশ)

৩য় মতানুযায়ী কুরআনের নৈতিকতা স্মরনে রেখে বলা হয়েছে চোরদের হাত নয় , তাদের চুরির সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের কেটে ফেলতে অর্থাৎ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বলা হয়েছে। এই মতের সমর্থনে ৩টি কারন দর্শানো হয়েছে।




১ম কারন - সকলেই জানেন বাংলায় কিছু শব্দ আছে যার আক্ষরিক ও আলঙ্করিক দুই ধরনের মানে করা হয়। যেমন – যদি বলা হয় আমার হাত ব্যাথা করছে। এখানে ‘হাত’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থেই হাতকে বোঝায়। কিন্তু যদি বলি , আমার খুব হাত টানাটানি যাচ্ছে। এখানে নিশ্চয় কেউ আমার হাত ধরে টানাটানি করছে না। এখানে হাতের আলঙ্করিক অর্থ বোঝানো হয়েছে , অর্থাৎ আমার টাকা বা সম্পদের অভাব ঘটেছে।



সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের বুঝাতে বাংলায় বা ইংরাজীতে বা আরবিতেও ‘হাত’ শব্দটি ব্যাবহৃত হয়। যেমন এরশাদ শিকদারের ডান হাত বা right hand man ছিল অমুক , এটা বলতে আমরা বুঝি এরশাদ শিকদারের প্রধান সহায়তাকারী ছিল অমুক। অমুকের পক্ষে এ কাজটা করা সম্ভব ছিল না , যদি না তমুকের হাত ওর পিছনে থাকত!! এখানে পৃষ্ঠপোষককে বুঝানো হয়েছে। কোন চোরের পক্ষে সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষক ছাড়া একা চুরি করা দূরুহ। তাকে চুরির মাল কারো না কারো কাছে বেচা লাগবে , কারো না কারো সহায়তা তার লাগবে। একারনেই সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের তার কাছ থেকে কেটে বা বিচ্ছিন্ন করে ফেল্লেই , তার চুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিচ্ছিন্ন কিভাবে করতে হবে তার বর্ননাও কুরআনে আছে। সে বর্ননায় পরে আসছি।



তদ্রুপ কুরআনেও ‘হাত’ (ইয়াদ) শব্দটি আক্ষরিক ও আলঙ্করিক অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে। প্রমানস্বরুপ ২৭:১২ , ৫:৬৪ , ৩৮:৪৫ আয়াতগুলো পড়ে দেখুন।



২৭:১২ “আপনার হাত আপনার বগলে ঢুকিয়ে দিন, সুশুভ্র হয়ে বের হবে নির্দোষ অবস্থায়। এগুলো ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের কাছে আনীত নয়টি নিদর্শনের অন্যতম। নিশ্চয় তারা ছিল পাপাচারী সম্প্রদায়।”

এই আয়াতে ‘হাত’ (ইয়াদ) শব্দটি আক্ষরিক অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে।



৫:৬৪ “আর ইহুদীরা বলেঃ আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরই হাত বন্ধ হোক। একথা বলার জন্যে তাদের প্রতি অভিসম্পাত। বরং তাঁর উভয় হস্ত উম্মুক্ত। তিনি যেরূপ ইচ্ছা ব্যয় করেন।….” এই আয়াতে ‘হাত’ (ইয়াদ) শব্দটি আলঙ্করিক অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে। এখানে হাত বন্ধ বলতে কৃপনতা বোঝায়।



৩৮:৪৫ “স্মরণ করুন, হাত ও চোখের অধিকারী আমার বান্দা ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কথা।” এখানেও ‘হাত’ (ইয়াদ) শব্দটি আলঙ্করিক অর্থে ব্যাবহৃত হয়েছে। আরো দেখতে পারেন ২:১৯৫, ২:২৩৭ ও ২২:১০ আয়াতগুলি।



তাহলে ৫:৩৮ আয়াতের তর্জমা যদি “যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের তাদের কাছ থেকে কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসেবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী। আল্লাহ পরাক্রান্ত, জ্ঞানময়।” এভাবে করা হয় তাহলে দেখুন ৫:৩৯ নং আয়াতের সাথেও কোন বিরোধ থাকে না।



৫:৩৯ “অতঃপর যে তওবা করে স্বীয় অত্যাচারের পর এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।”



২য় কারন - মানুষ খুন করা নিশ্চয় চুরি করার থেকেও জঘন্য অপরাধ। কুরআনে খুনীর জন্য দুই ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ৪:৯২ আয়াতে বিশ্বাসীদের অনিচ্ছাকৃত খুনের শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এই শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও নয় বা জেল বাস ও নয়। ৪:৯২ “মুসলমানের কাজ নয় যে, মুসলমানকে হত্যা করে; কিন্তু ভুলক্রমে। যে ব্যক্তি মুসলমানকে ভূলক্রমে হত্যা করে, সে একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং রক্ত বিনিময় সমর্পন করবে তার স্বজনদেরকে; কিন্তু যদি তারা ক্ষমা করে দেয়। অতঃপর যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং যদি সে তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে রক্ত বিনিময় সমর্পণ করবে তার স্বজনদেরকে এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে। অতঃপর যে ব্যক্তি না পায়, সে আল্লাহর কাছ থেকে গোনাহ মাফ করানোর জন্যে উপর্যুপুরি দুই মাস রোযা রাখবে। আল্লাহ, মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।”



ইচ্ছাকৃত খুনের শাস্তি – ২:১৭৮ “হে ঈমানদারগন! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যাক্তি বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।”



দুটো আয়াতেই দেখুন ক্ষতিপুরন দেয়া ও ক্ষতিপুরন দিয়ে মৃত্যুদন্ড রহিতের ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। এটা হয়তোবা খুন হওয়া ব্যাক্তির পরিবারের ভরনপোষনের স্বার্থে করা হয়েছে। খুনীর এই যে শাস্তি , এটা নিশ্চয় চোরের হাত কেটে ফেলার শাস্তির চেয়ে বেশী নয়। চুরির শাস্তি তো আর খুনের শাস্তির চেয়ে বেশি হতে পারেনা?



৩য় বা শেষ কারন আল্লাহ সুরা ইউসুফে (১২) উদাহরন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন , চোরের শাস্তি কিভাবে দিতে হবে।



১২:৭০ অতঃপর যখন ইউসুফ তাদের রসদপত্র প্রস্তুত করে দিল, তখন পানপাত্র আপন ভাইয়ের রসদের মধ্যে রেখে দিল। অতঃপর একজন ঘোষক ডেকে বললঃ হে কাফেলার লোকজন, তোমরা অবশ্যই চোর।

১২:৭১ তারা ওদের দিকে মুখ করে বললঃ তোমাদের কি হারিয়েছে?

১২:৭২ তারা বললঃ আমরা বাদশাহর পানপাত্র হারিয়েছি এবং যে কেউ এটা এনে দেবে সে এক উটের বোঝা পরিমাণ মাল পাবে এবং আমি এর যামিন।

১২:৭৩ তারা বললঃ আল্লাহর কসম, তোমরা তো জান, আমরা অনর্থ ঘটাতে এদেশে আসিনি এবং আমরা কখনও চোর ছিলাম না।

১২:৭৪ তারা বললঃ যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও, তবে যে, চুরি করেছে তার কি শাস্তি?

১২:৭৫ তারা বললঃ এর শাস্তি এই যে, যার রসদপত্র থেকে তা পাওয়া যাবে, এর প্রতিদানে সে দাসত্বে যাবে। আমরা যালেমদেরকে এভাবেই শাস্তি দেই।

১২:৭৬ অতঃপর ইউসুফ আপন ভাইদের থলের পূর্বে তাদের থলে তল্লাশী শুরু করলেন। অবশেষে সেই পাত্র আপন ভাইয়ের থলের মধ্য থেকে বের করলেন। এমনিভাবে আমি ইউসুফকে কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম। সে বাদশাহর আইনে আপন ভাইকে কখনও দাসত্বে দিতে পারত না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আমি যাকে ইচ্ছা, মর্যাদায় উন্নীত করি এবং প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরে আছে অধিকতর এক জ্ঞানীজন।

১২:৭৭ তারা বলতে লাগলঃ যদি সে চুরি করে থাকে, তবে তার এক ভাইও ইতিপূর্বে চুরি করেছিল। তখন ইউসুফ প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনে রাখলেন এবং তাদেরকে জানালেন না। মনে মনে বললেনঃ তোমরা লোক হিসাবে নিতান্ত মন্দ এবং আল্লাহ খুব জ্ঞাত রয়েছেন, যা তোমরা বর্ণনা করছ;

১২:৭৮ তারা বলতে লাগলঃ হে আযীয, তার পিতা আছেন, যিনি খুবই বৃদ্ধ বয়স্ক। সুতরাং আপনি আমাদের একজনকে তার বদলে রেখে দিন। আমরা আপনাকে অনুগ্রহশীল ব্যক্তিদের একজন দেখতে পাচ্ছি।

১২:৭৯ তিনি বললেনঃ যার কাছে আমরা আমাদের মাল পেয়েছি, তাকে ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। তা হলে তো আমরা নিশ্চিতই অন্যায়কারী হয়ে যাব।”



উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহর আইনে চুরির শাস্তির প্রয়োগ কিভাবে হবে তা দেখানো হয়েছে।

১২:৭ “অবশ্য ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।”

১২:৩৮ “আমি আপন পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ধর্ম অনুসরণ করছি। আমাদের জন্য শোভা পায় না যে, কোন বস্তুকে আল্লাহর অংশীদার করি। এটা আমাদের প্রতি এবং অন্য সব লোকের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ। কিন্ত অধিকাংশ লোক অনুগ্রহ স্বীকার করে না।”



উপরের আয়াতগুলো থেকে এটা পরিস্কার তারা রাজার আইন (১২:৭৬) অনুসরন করেনি , বরং চোরকে শাস্তি দিয়েছে আল্লাহর আইনে(১২:৭৫)। লক্ষ করুন ওরা ১২:৩৮ “আমি আপন পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ধর্ম অনুসরণ করছি।”






দেখা যাচ্ছে আল্লাহর আইনে চোরের শাস্তি নিম্নরুপ :


১) সন্দেহভাজন চোরকে প্রথমেই চুরি স্বীকার করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং স্বীকার করে চুরির মাল ফেরৎ দিলে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।১২:৭২


২)৫:৩৮ চুরি প্রমান হলে তার সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের থেকে কেটে ফেলা হবে অর্থাৎ সে দাসত্বে যাবে।১২:৭৫ এর অর্থ দাড়ায় চোরাই মালের টাকা বা জরিমানার সমপরিমান অর্থ চোর শ্রম মজুরি দিয়ে শোধ দিবে।



এখন দেখুন এরপরে যদি চোর ক্ষমা চায় ও অনুতপ্ত হয় , তাহলে তাকে ক্ষমা করা সম্ভব।

আয়াতগুলো থেকে আমরা আরো জানতে পারি যে কাউকে চুরির দায়ে ফাসানো সম্ভব। হাত কেটে ফেল্লে যার চুরির মিথ্যা অভিযোগে হাত কাটা গেছে , তার হাত কিভাবে ফেরৎ দেয়া যাবে। আর চুরির শাস্তি যদি হাত কেটেই ফেলা হবে , তাহলে নিশ্চয় ইউসুফ নিজের আদরের ভাইকে চুরির দায়ে ফাসাতো না।



আজকের মুসলমান ভাইয়েরা বলতে পারেন , এই আইন সেই ইউসুফের জমানার জন্য প্রযোজ্য ছিল , আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এর উত্তরে বলব , আল্লাহ আমাদের এই কাহিনী শুনিয়েছেন কিছু শেখানোর জন্য , আনন্দ উপভোগের জন্য নয়।



পোস্টের শুরু করেছিলাম সূরা ইউসুফের ১ম আয়াত দিয়ে , শেষ করছি শেষ আয়াত দিয়ে।





১২:১১১ তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ রহমত ও হেদায়েত।






No comments:

Post a Comment