Thursday, April 12, 2012

ধর্ম বনাম বিজ্ঞান (১)

প্রাচীন কালে ধর্ম ও বিজ্ঞান একে অন্যের পরিপূরক হিসাবে পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে , তবে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এদের মাঝে দ্বন্দ্ব বাড়তে বাড়তে চরম ধর্ম বিরোধে রূপ নেয় অষ্টাদশ উণবিংশ শতাব্দিতে এসে। এই সময়ে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে অনেকেই অনুভব করতে থাকেন যে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তিতে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এর অন্যতম কারন হলো , এতদিন বিশ্বাস করা হতো অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির অস্তিত্ব  ছাড়া এই মহাবিশ্বের  কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। এখন ধর্ম বিরোধীরা বলতে লাগলেন , যেহেতু বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে এখন অতিপ্রাকৃত কোন শক্তি বা 'গড' হাইপোথেসিস ছাড়াই এই মহাবিশ্বের সকল দিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব , সেকারনে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তিতে বিশ্বাস বাহুল্য হয়ে পড়েছে। যেহেতু এই মহাবিশ্বের সকল প্রকৃয়া কিছু প্রাকৃতিক আইন মেনে পরিচালিত হয় , সেহেতু অতিপ্রাকৃত কোন শক্তি এই মহাবিশ্বকে পরিচালিত করছে  এমনটি ভাবা একমাত্র বদ্ধমনা সাধারন জ্ঞাণ বিবর্জিত মূর্খ আস্তিকদের পক্ষেই সম্ভব।  তাই কী?

 এই মহাবিশ্বে যা কিছুই ঘটে , তা ঘটে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির ইচ্ছা বা কারনে , এমনটাই প্রাচীন কাল থেকে আস্তিক মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দাবী করে , প্রতিটি ঘটনার পিছনে একটি কারন আছে। কারন ছাড়া কিছুই ঘটে না এবং এই কারন পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে জানা সম্ভব। এই যেমন নিউটন পর্যবেক্ষন করলেন , বিশাল এই মহাবিশ্বের সকল গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি নির্দিষ্ট এক আইন মেনে বিশ্ব পরিক্রমন করে চলেছে , যা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হওয়ার উপায় নেই। এই আইনের নাম - মহাকর্ষ আইন।  ডারউইনের পর্যবেক্ষন বা গবেষনা থেকে জানা গেল - অতিপ্রাকৃত কোন শক্তি 'হও' বল্লেন আর  মানুষ সৃষ্টি হয়ে গেল এমনটা নয় , বরং ধাপে ধাপে জৈবিক আইন মেনে বিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিম্ন প্রজাতি থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই পর্যবেক্ষনের ও গবেষনার তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা অনুমান (inference)করে থাকেন যে , এই মহাবিশ্বের সকল ঘটনা এক কঠিন আইনে আবদ্ধ , যার অপর নাম - প্রাকৃতিক আইন ‘Law of Nature'।

জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant) তো ঘোষনাই দিলেন , " আমাকে কিছু পদার্থ (matter) দাও , আমি দেখিয়ে দেব কিভাবে পদার্থ থেকে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।"  হেকেল (Haeckel) আরো এক ধাপ এগিয়ে বল্লেন - পানি , রাসায়নিক উপাদান ও সময় দেয়া হলে , তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে পারবেন। নিৎসে (Nietsche) বিজয় ঘোষনা দিলেন , আল্লাহ মৃত।

মজার ব্যাপার হলো প্রাকৃতিক আইনের আবিষ্কর্তা এই নায়কেরা প্রায় সকলেই ছিলেন আস্তিক। নাস্তিকদের ধারনা অজ্ঞতা থেকেই মানুষ ধর্ম বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অতীতের মানুষ ঘটনার কারনগুলো জানতনা বলেই বিশ্বাস করত অতিপ্রাকৃত কোন শক্তিই সকল কিছুই ঘটিয়ে থাকে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষ যখন প্রকৃত কারন জানবে , তখন ধর্ম বিশ্বাস এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেমনটি জুলিয়ান হাক্সলি তার বইয়ে লিখেছেন-

 "রংধনু আকাশে 'গডের' কোন নিদর্শন নয় , কারন পড়ন্ত বৃষ্টির কণায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হলেই আকাশে রংধনূ দেখা যায়। প্লেগকে আল্লাহর গজব হিসাবে দেখার কোন উপায় নেই , কারন প্লেগের কারন হলো Bacillus pestis নামের এক জীবাণু , যা ইদুরের মাধ্যমে ছড়ায়। সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ যেহেতু লক্ষ কোটি বছর ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের অবস্থায় পৌছেছে , সেহেতু প্রাণী ও উদ্ভিদের সৃষ্টিতে আল্লাহর হাত আছে বলাটা বাতুলতা মাত্র। হিস্টেরিয়া ও পাগলামি যদি মনের বৈকল্যের কারনে ঘটে থাকে , তাহলে কোনভাবেই একে ভুত বা শয়তানের আছর লেগেছে বলা যায় না।" মোদ্দা কথা হলো - ঘটনা যদি প্রাকৃতিক কারনে ঘটে থাকে , তাহলে এগুলো অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির কারনে যে ঘটেনি তা নির্দ্বীধায় বলা যায়।

ধর্মবিরোধীদের এই যুক্তির স্বাভাবিক কিছু দুর্বলতা আছে। ধরুন রেল লাইনের উপর দিয়ে একটি রেল গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ির চাকা কেন ঘুরছে? গাড়ির ইন্জিন ও এর যন্ত্রাংশ পর্যবেক্ষন ও পরীক্ষার পরে এই স্বীদ্ধান্তে উপনীত হব গাড়ির ইন্জিন ও এর যন্ত্রাংশের কারনেই গাড়ির চাকা ঘুরছে। এই উত্তর কি যথেষ্ঠ?  অবশ্যই না।  ইন্জিনিয়ার , যিনি রেল ইন্জিনের ডিজাইন করেছেন এবং রেলের চালকের ভূমিকা সম্পর্কে না জানলে উত্তর সম্পুর্ন হবে না। কারন রেল ইন্জিন নিজে নিজেই তো আর তৈরি হতে পারে না বা নিজে নিজেই চলা শুরু করতে পারেনা। রেল গাড়ির ইন্জিন ও এর যন্ত্রাংশ সর্বশেষ বাস্তবতা নয়। সর্বশেষ বাস্তবতা হলো মন , যা এই রেল গাড়ির ইন্জিন ও এর যন্ত্রাংশকে অস্তিত্বে এনেছে  এবং একে ইচ্ছামত পরিচালনা করছে। আসলে প্রকৃতি ব্যাখ্যা দেয় না , বরং প্রকৃতিকেই ব্যাখ্যা করার দরকার।

ডিমের শক্ত খোলশ ভেঙ্গে  কিভাবে নরম মাংসের  মুরগির ছানা বের হয়? অজ্ঞ মানুষ এর পিছনে আল্লাহর হাত আছে বলে বিশ্বাস করে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যানে ধর্ম বিরোধীদের যুক্তি হলো আল্লাহর হাত নয় বরং ২১ দিনের মাথায় মুরগির ছানার ঠোটে একটি সাময়িক শক্ত শিং গজায় , যেটা দিয়ে ডিমের শক্ত খোলশ ভেঙ্গে মুরগির ছানা বের হয়। এই যুক্তি একটি ফ্যালাসী। কারন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে , ঠিক ঠিক ২১ দিনের মাথায় মুরগির ছানার ঠোটে একটি সাময়িক শক্ত শিং গজানোর পিছনে যে আল্লাহর হাত নেই , তা কিভাবে তারা নিশ্চিত হলেন?  আসলে বিজ্ঞানীরা ঘটনার কার্যকারনের শৃঙ্খলে একটি নুতন লিঙ্ক যোগ করেছেন মাত্র। একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা আরো বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। যেমনটি এর পরেই প্রশ্ন আসবে - শক্ত শিং গজায় কেন? ২১ দিনের বদলে ৩১ দিন পরেই বা না কেন? ইত্যাদি।

জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আমরা প্রকৃতিকে আরো ভাল ভাবে বুঝতে পারছি ঠিকই , তবে এই জ্ঞান  অতিপ্রাকৃত কোন শক্তির অনস্তিত্বের প্রমান নয়। আদিম মানুষ অজ্ঞানতার ফলে বিশ্বাস করত রংধনু আল্লাহর নিদর্শন , আজ  ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক আস্তিক বিশ্বাস করে রংধনু আল্লাহর নিদর্শন এবং  পড়ন্ত বৃষ্টির কণায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে সেটা তিনি করে থাকেন। আদিম মানুষ অজ্ঞানতার ফলে বিশ্বাস করত প্লেগ আল্লাহর গজব , আজ  ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক আস্তিক বিশ্বাস করে প্লেগ আল্লাহর গজব এবং সেটা তিনি Bacillus pestis ও ইদুর দিয়ে ঘটিয়ে থাকেন। তেমনিভাবে বিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ সহ সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করতেই পারেন। এখানে বিজ্ঞানের সাথে তো ধর্মের কোন বিরোধ দেখি না।

ফলে আমরা  দেখি- বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের সময়েও ধর্ম বিলীন হয়ে যায় নি , যেমনটি নিৎসে (Nietsche) বিজয় ঘোষনা দিয়েছিলেন বা কান্টের ঘোষনা মতো পদার্থ থেকে আরেকটি  মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে কেউ এখনো দেখাতে পারেনি বা হেকেলের দাবী মতো   পানি , রাসায়নিক উপাদান ও পর্যাপ্ত সময় দেয়া হলেও কেউ এখনো মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনি।

Thursday, April 5, 2012

মূসা নবীর ফেরাউন কে ছিল? (৪)

Koptos – Coptos – Qobt – Qibt – Egypt এই নামেই ৫০০০ বছর ধরে দেশটি পরিচিত।

মিশর/Misr নামে কবে থেকে দেশটি পরিচিতি পেল?

খৃঃপূঃ ৪র্থ শতকে মহাবীর আলেক্জান্ডার সেই সময়কার সর্ববৃহৎ ও শক্তিমান গ্রীকসম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন , যার অধীনে ছিল পশ্চিম ভারত , ইরান , মেসোপটেমিয়া ও ইজিপ্ট। ফলে গ্রীক ভাষা , আজকের ইংরেজি ভাষার মতোই সেই সময়কার পৃথিবীতে সর্বব্যাপী ছিল। সেই সময়ে গ্রীক ম্যান্ডেট নিয়ে ইজিপ্টের শাসনকর্তা ছিলেন টলেমি ফিলোডেলফিস , যিনি টলেমি২ নামেই বিশ্বে বেশি পরিচিত।  

 
Alexander's Empire, during its zenith (4th Centiry B.C)

টলেমি২ কিছু ইহুদী ধর্মজাযককে নিয়োগ করেন বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টকে আরামিক থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার জন্য। এরাই প্রথম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সর্ব প্রথম বাইবেলে বর্ণীত মিসরিমের অনুবাদ করেন ইজিপ্ট। সেই থেকেই গ্রীক বাইবেলের কল্যানে সারা পৃথিবীর খৃষ্টান ও ইহুদীরা ইজিপ্টকে মিশর/Misr নামেই চেনে। সাধারনত কোন দেশ বা জায়গার নাম অনুবাদ করার সময় অপরিবর্তিতই থাকে বা উচ্চারনের সুবিধার জন্য সামান্য কিছু পরিবর্তন হয় যার সাথে আদি নামের মিল থাকে। যেমন 'ঢাকা' ইংরেজিতে Decca , কলিকাতা-calcutta। কিন্তু দেখুন মিসরিমের/Misrim সাথে ইজিপ্টের /Egyptus কোনই মিল নেই। সম্পুর্ন ভিন্ন দুটি নাম।

আরামিক বাইবেলের যেখানেই মিসরিম/Misrim লেখা আছে , সেখানেই গ্রীক বাইবেলে অনুবাদ করা হয়েছে ইজিপ্ট /Egyptus । এখন দেখি আরামিক বাইবেল থেকে একটি আয়াত (Genesis 21:21):

וישׁב במדבר פארן ותקח־לו אמו אשׁה מארץ מצרים

আরামিক আরবির মতোই বাম থেকে ডানে লেখা হয়। আন্ডারলাইন করা শেষ শব্দটিই হলো মিসরিম।

প্রথম বর্ণ "מ" 'মেম'  উচ্চারিত হয় 'ম'
২য় বর্ণ "צ" 'ত্সেড'  উচ্চারিত হয় 'স'
৩য় বর্ণ "ר" 'রেশ'  উচ্চারিত হয় 'র'
৪র্থ বর্ণ "י" 'ইয়োড'  উচ্চারিত হয় 'ই'
৫ম বর্ "ם" এটাও 'মেম' বা 'ম' (শব্দের শেষে থাকলে এভাবে লেখা হয়)

একসাথে করলে পাই- 'মিসরিম' ( আদি আরবি কোরানে যেমন লেখা ছিল না , তেমনি আরবির মতোই আরামিক ভাষায় জের , জবর , পেশ লেখা হয় না)

এখন দেখুন এর অনুবাদ গ্রীক ভাষায় করা হয়েছে Αἰγύπτου.

প্রথম বর্ণ :  "A"  “আলফা”, উচ্চারিত হয়  “a”.
২য় বর্ণ: "ἰ" “আয়োটা”, উচ্চারিত হয়  “i”.
৩য় বর্ণ: "γ" “গামা”, উচ্চারিত হয়  “g”.
৪ট্থ বর্ণ: "ύ"   “উপসিলন”, উচ্চারিত হয়  “i”or “y”
৫ম বর্ণ: "π"   “পাই”, উচ্চারিত হয়  “p”.
৬ষ্ঠ বর্ণ: "τ”   “টাউ”, উচ্চারিত হয়  “t”.
৭ম বর্ণ: "ο"   “অমিক্রন”, উচ্চারিত হয়  “o”.

এখন একসাথে করলে পাই- A-i-g-i(y)-p-t-o (ইজিপ্টো).

ইজিপ্ট যদি মিশর না হবে , তাহলে বাইবেল বা কোরানে যে মিসরিম/مصر এর কথা বলা হয়েছে , সেটা তাহলে কোথায়? এর উত্তর ভবিষ্যতে দেয়ার ইচ্ছা রইল।