Saturday, February 25, 2012

কোরান অবমাননা



গত ৩ দিন (২১-২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১২) কোরান পোড়ানোর প্রতিবাদে আফগানিস্তানে সহিংস প্রতিবাদ অব্যহত আছে। এ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে আনুমানিক ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও আরো অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত। সারা মুসলিম বিশ্বে  এই সহিংস প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশংকাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

কোরান অবমাননার ঘটনা যূগে যূগে অতীতে আরো বহুবার ঘটেছে।  এনিয়ে ২০০৫ সালে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বরখাস্তকৃত প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ আহমদ মনসুরের কাছে লেখা এক মিশরীয়ের লেখা চিঠির জবাবে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন , সেটার কিয়দাংশ সকলের অবগতির জন্য এখানে পেশ করছি-

এক পাঠক আমাকে ভর্ৎসনা করে একটি চিঠি লিখেছেন- "সত্যি বলতে , কোরান অবমাননার বিষয়ে আপনাকে নিঃশ্চুপ থাকতে দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি।"  তিনি উষ্কানিমূলকভাবে আমাকে প্রশ্ন করেছেন , আপনি আমেরিকায় বাস করেন বলেই কি আমেরিকান সরকারের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ? (সেই সময়ে উনি মিশর থেকে বিতাড়িত হয়ে আমেরিকায় বসবাস করতেন) নাকি আপনার সময় হয় শুধুমাত্র আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ধর্মীয় গুরুদের সমালোচনা করার?
নাকি সারারাজীবণ যে ইসলাম ও কোরানের সমর্থনে লেখার দাবী আপনি করে থাকেন , সেটা ভুলে গেছেন?  নাকি কোরান ও ইসলাম এখন আর আপনার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করে না?

আমি তাকে জবাব দিয়েছি , " মহান ভাই আমার , আমি আল-জজিরা টেলিভিশনে বলেছি , যারা জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে কোরান অবমাননার কাজ করে , তাদের শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমি ছাড়াও আরো অনেক আমেরিকান একি কথা বলেছে। তবে আমেরিকানরা কোরান অবমাননার নিন্দা করেছে , এ কারনে নয় যে তারা কোরানে বিশ্বাস করে। বরং তারা যে কোন ধর্মের  অবমাননার বিপক্ষে বলেই নিন্দা করেছে। একথা ভুল্লে চলবে না যে এদের সমাজে খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্মগ্রন্থের অবমাননার নিন্দা ও প্রতিবাদ ও তারা একারনেই করে থাকে।  এটা একটা উম্মুক্ত সমাজ। কোন কিছুই এখানে বেশি দিন গোপন করে রাখা যায় না। যে কেউ এখানে বাড়াবাড়ি করে , সেই তার ন্যায্য ও যথাযথ শাস্তি পায় এদের দেশের আইন অনুসারে। আমি আল্লাহকে সামনে রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,এদের থেকে ভাল বিচার ব্যাবস্থা ও  মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আমি অন্য কোন দেশকে দেখিনি। আমি আমেরিকা ও তার সিস্টেমকে ডিফেন্ড করছি না , যেটা আমার কাছে সত্য মনে হয়েছে , সেটাই বল্লাম। এমনও ঘটেছে এই আমেরিকাতেই বিভিন্ন সম্মেলনে ইংরেজিতে আমি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছি , যা আমেরিকানদের জন্য সুখকর ছিল না।  এদের দেশে বলার স্বাধীনতাকে আমি উপভোগ করি , যেটা আমার দেশে আমি পাই নি।

গুয়ান্তানামো বেতে কোরান অবমাননার ঘটনার সংবাদ সর্বপ্রথম আমেরিকার মিডিয়ায় জনসম্মুখে তুলে আনে। যেমনটি তুলে এনেছিল ইরাকের আবু গ্রেইব বন্দিশালায় বন্দিদের উপরে আমেরিকান সৈন্যদের অত্যাচারের ভিডিও চিত্র। আশা করা যায় আবু গ্রেইবের মতোই এবারো তদন্ত হবে এবং দোষী ব্যাক্তিরা যথাযথ শাস্তি পাবে। আমেরিকার এই উম্মুক্ত সমাজে নিজেদের সকল ভুল বা অন্যায়কে এরা সামনে নিয়ে আসে , খোলাখুলি আলোচনা করে এবং দোষী ব্যাক্তির শাস্তি নিশ্চিত করে , তা যেই হোক না কেন।

এর বিপরীতে আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে আমরা কি দেখি? ভাবখানা এমন যে এদের দেশের বন্দিশালায় কোন ধরনের নির্যাতন করা হয় না এবং তাদের মাঝে এখন বা সুদুর অতীতে ও কখনো কোরান অবমাননার মতো ঘটনা কখনো ঘটে নি। যে কারনে তারা নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে আমেরিকার সমালোচনা করে , যেন এমনটাই আমেরিকান পলিসি। যে কোরান অবমাননার জন্য জীবণ দিচ্ছে , সেই কোরানে লিখিত আল্লাহর বাণীকেই ভুলে বসে আছে-
২:৪৪ তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভূলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?


আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই ,  কোরান বা ছাপানো কোরানের (মুস-হাফ) অবমাননাকে আমি কঠোর ভাবে নিন্দা জানাই এবং এর অবমাননাকারী মুসলমান বা অমুসলমান যেই হোক না কেন , তাকে অভিশাপ দেই।
কোরান অবমাননার প্রতিক্রিয়া নিয়ে মুসলমানদের দ্বিচারিতা বা ভন্ডামি নিয়ে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন। মুসলমান বলতে আমি সরলিকরন করে সকল মুসলমান নয় , বরং বেশিরভাগ মুসলমানকেই বুঝাচ্ছি।

১) আমরা সাধারনত সারা বিশ্বকে জ্ঞান দিতে ও সঠিক রাস্তা দেখাতে উৎসাহী , যেখানে আমরা নিজেরাই ভুল পথে আছি। আমরা সবসময় অন্যের দোষ ত্রুটি ও দুর্বলতা পর্যবেক্ষন করি , যদিও আমরাই সবচেয়ে দূর্ণীতিগ্রস্থ ও ভন্ড। যদি আমরা নিজেদের নিয়োজিত রাখতাম নিজেদের সংশোধনে এবং নিজেদের পাহাড়সম দুর্ণীতি ও দোষ মুক্ত হতে , তাহলে অন্যদের দোষ ও দুর্বলতা খোজার সময় আমাদের থাকত না। কিন্ত আমরা সেটা করতে অস্বীকার করি। আমরা নিজেদের অতীতের গৌরবকাথা ও সফলতা নিয়ে বারংবার বলতে এমনি পছন্দ করি যে , এটা দিবাস্বপ্ন দেখার সামিল হয়ে পড়েছে। যার ফলে আজ আমরা পৃথিবীর আর সকল মানুষের চোখে সবচেয়ে খারাপ সম্প্রদায়রুপে চিহ্নিত হয়েছি এবং রাষ্ট্রসমূহের মাঝে বিরাজমান উত্তেজনা ও ঝামেলার কারন হিসাবে মুসলমানদের দায়ী করা হচ্ছে।

আজ যারা রাস্তায় জঙ্গী মিছিল করছে ও জীবণ দিচ্ছে , তাদের ধারনা কোরানের অবমাননা শুধুমাত্র  আমেরিকান সৈন্য ও ইহুদী সৈন্যরাই করে থাকে। এটা ভুল। এরা না জানে ইতিহাস , না জানে এদের নেতা ও মোল্লারা। মুসলমান খলিফা , শাসক , মুসলিম উলামা , সুফি সাধক কর্তৃক কোরান অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সুদুর অতীতে যখন আমেরিকা বলে কোন দেশ ছিল না।

কিছু উদাহরন-

ক) উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আব্দিল-মালিকের শাসন কাল ছিল ১২৫ হিঃ থেকে ১২৬ হিঃ সাল। তার নারী আসক্তি , ব্যাভিচার , সৎমাদের সাথে যৌণসংসর্গ ও মদাসক্তি নিয়ে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি যখন সিংহাসনের উত্তরাধিকার ছিলেন , সেই সময় কাবা ঘরের ন্যায় গম্বুজ বানিয়ে মদ নর্তকি , কুকুর নিয়ে মক্কা রওয়ানা হয়েছিলেন সেটা কাবার উপরে স্থাপনের জন্য। বণু হাশিমেরা অভিযোগ করে যে , তিনি ছিলেন প্যাগান বা জান্দাক এবং পরকাল ও কোরানে বিশ্বাস করতেন না। এক অতি বিখ্যাত ঘটনার বর্ণনায় পাওয়া যায়-  একদিন লিখিত কোরান (মুস-হাফ) খুল্লে তার চোখ পড়ে এই আয়াতের পরে , যেখানে আল্লাহ বলেছেন " প্রত্যেক অবাধ্য, অন্যায়পরায়ন শাসক ব্যর্থ কাম হবে" তিনি তখন মুস-হাফ ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং তীর ছুড়ে মুস-হাফকে ফুটো করে ফেল্লেন। এবং একটি কবিতা লিখলেন-

"তুমি আমাকে অবাধ্য, অন্যায়পরায়ন শাসক বলে ভয় দেখাও? যখন তুমি শেষ বিচারের দিনে তোমার রবের সম্মুখে উপস্থিত হবে
 বলুন , হে আমার প্রভু ,  আল-ওয়ালিদ আমাকে তীর মেরে ফুটো করে দিয়েছে।"
(সুত্র - “The Complete History” (Taareekh al kaamil) by Ibn Il-Atheer, volume 4, page 486.  Also Al-Muntadhim  by Ibn-Il-Jawzi, volume 7, pages 236 – 248.)

খ)হিজরী ৯ম শতকে বিখ্যাত সুফি সাধক শেখ ইবনে আল-বাকাকী রমজানে ইচ্ছাকৃত ভাবে রোজা থাকতেন না এবং লিখিত কোরান (মুস-হাফ) মাটিতে রেখে তার উপরে দাড়িয়ে উচু তাক থেকে জিনিষপত্র নামাতেন।
(সুত্র -(Ibn Hajar, “Ad-durar il kaaminah”,  volume 9, page 329.)

গ)আমাদের এই যূগে  বর্তমানে ও মুসলিম দেশগুলোতে  কোরান অবমাননার ঘটনা অহরহ ঘটছে। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য যারা মুবারকের আমলে কারাভোগ করেছে ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে , তাদেরকে নির্যাতনের অন্যতম পন্থা ছিল আল্লাহকে গালি দেয়া ও লিখিত কোরান (মুস-হাফ) তাদের সামনে ছিড়ে ফেলা। লিখিত কোরানের (মুস-হাফ) ভিতরে পিস্তল রেখে ব্রাদারহুডের উপরে দোষ চাপানো হয়েছিল , এমনটি আমাকে লেখক ও সাংবাদিক আব্দিল-মুনিম আল-জিদ্দাওয়ী বলেছেন।

সুতরাং আপনি বুঝতেই পারছেন , আমেরিকান  সৈন্যরাই প্রথম ও একমাত্র অপরাধী নয় যারা যূগে যূগে কোরানের অবমাননা করেছে।  অতীতে ঘটা কোরান অবমাননার এমন অনেক ঘটনা জানতে চাইলে “The Great Levels” (At-Tabaqaat Al Kubraa) by  Ash-Sha'araani, volume 2.  পড়ে দেখতে পারেন। এটা এখনো ছাপা হয় ও সহজেই জোগাড় করা সম্ভব।

চিঠির পরবর্তী অংশে অধ্যাপক ডঃ আহমদ মনসুর সর্ব যূগের মুসলিমদের কোরান নিয়ে ভন্ডামির নমুনা তুলে ধরেছেন। এই ভন্ডামি নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার আশা রইল।