সম্প্রতি কিছু লোক আছে যারা হাদিস মানে না , তাফসির মানে না , তার পরে আবার নিজেদের মন মত কোরানের বানীর অর্থ করে। ভাবখানা আল্লাহ নতুন করে তাদের কাছে কোরান নাজিল করছে। সেটা না করে অবশ্য উপায়ও নেই , প্রচলিত কোরান , হাদিস , তাফসির গ্রহন করলে ইসলামের যে চেহারা দাড়ায় তা তাদেরকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
যেমন একদল আছে যারা কোরানের নাসিক - মানসুক ( আয়াত রহিত/রদকরন ) মানে না। কারন এসব মানলে ইসলামের এমন চেহারা দাড়ায় যা সভ্য সমাজে গ্রহনযোগ্য হয় না। মুস্কিল হলো সাধারন মানুষ যারা কোরান হাদিস পড়ে না তারা কিন্তু এটা জানে না। আর মোল্লারা যারা এটা জানে , তারা বিষয়টি বেমালুম চেপে গিয়ে সাধারন মানুষের সামনে নাগাড়ে মিথ্যাচার করে যায়। বিষয়টা একটু ব্যখ্যা করা যাক---------
সম্প্রতি নয় , ইসলামের শুরু থেকেই হাদিস ও তাফসির না মানা মুসলমান বিদ্যমান ছিল। এদের হাতেই ছিল ইসলামের নবীর মৃত্যু পরবর্তি শাসন ক্ষমতা। ইতিহাস থেকে জানা যায়- নবী জীবিত থাকা কালিন নবীর নির্দেশে আবুবকর ওমর সহ সকল সাহাবি তাদের কাছে রক্ষিত স্বলিখিত সকল হাদিস পুড়িয়ে ফেলেন। ওমর তার শাসনামলে সকল ধরনের হাদিস বর্ণনা ও প্রচার নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর কারন হিসাবে তিনি বলেছিলেন মুসলমানদের জন্য আল্লাহর বই 'কোরান' যথেষ্ঠ এবং তিনি চান না মুসলমানরা পূর্বের জাতিগুলোর ন্যায় রসূলের হাদিসকে গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর বাণীকে গুরুত্বহীন করে ফেলুক। একারনে আমরা দেখতে পাই আবু হুরায়রা নিজেই স্বীকার করেছেন যে বেতের ভয়ে ওমরের শাসনামলে তিনি কোন হাদিস বর্ণনা করেন নি। (উল্লেখ্য আব্বাসীয় আমলে বিব্লিওক্লাজম বা সকল বই ও গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার কারনে ইসলামের শুরু থেকে পরবর্তী ১৫০-২০০ বছরের যে ইতিহাস আমরা জানি তার সাথে সত্যের মিল সামান্যই বলে মনে হয়)
অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তি ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষনের মাধ্যমে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত দলটি ইতিহাসে মুতাজিলা নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে ইব্রাহিম নাজ্জাম নামে এক বিখ্যাত মুতাজিলা নেতা ছিলেন , যিনি কোরানই ইসলামের একমাত্র উৎস বলে প্রচার করতেন এবং প্রচন্ডভাবে হাদিস ও সুন্নাহ বিরোধী ছিলেন। বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ সকল মুতাজিলাই কোরান অনলি মুসলমান ছিলেন।
সুন্নি ও শিয়া সুত্রানুসারে - মুতাজিলারা 'আহলে আদল ওয়া তাওহিদ' বা 'ন্যায় বিচার ও একেশ্বরবাদী' দল নামে পরিচিত। খলিফা আল মামুনের সময় মুতাজিলা মতবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় ও বিস্তার লাভ করে। কাজি আব্দুল জব্বারের মৃত্যুর সাথে মুতাজিলাদের রাজনৈতিক প্রভাবের অবসান ঘটে।
হাদিস বিরোধীতার সবচেয়ে পুরানো যে দলিল পাওয়া যায় , সেটা হলো ৭৬হিঃ/৬৯৫খৃঃ খলিফা আব্দুল মালেককে লেখা আব্দুল্লা ইবনে ইবাদের লেখা একটা চিঠি। উক্ত চিঠিতে কুফাবাসীদেরকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে কোরানকে পরিত্যাগ করে হাদিসকে ধর্মের ভিত্তি হিসাবে গ্রহন করার জন্য।"তারা এমন একটি বইতে বিস্বাস করে যা আল্লাহর থেকে নয় , মানুষের হাত দ্বারা রচিত এবং এটাকে রসূলের বাণী বলে দাবী করে।"(Michael Cook, Muslim Dogma, Cambridge University Press, Cambridge, 1981)
আব্বাসীয় আমলে ও পরবর্তিতে সেলজুক খলিফাদের শাসনামলে হাদীস বিরোধীদের সকল বই ও গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার কারনে হাদীস বিরোধী লেখা পাওয়া যায় না। তবে এদের উপস্থিতী ও যুক্তি সম্পর্কে জানা যায় শরিয়া আইনের জনক ও প্রবর্তক ইমাম শাফেয়ীর বই 'জিমা আল ইলম' ও ইবনে কুতাইবার লেখা থেকে। তাদের লেখা থেকে জানা যায় তাদের সময়ে হাদীস বিরোধীতা ছিল সর্বব্যাপি এবং তাদের লেখায় তারা হাদীস বিরোধীদের যুক্তিকে খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন।
চতুর্দশ শতাব্দির দুই স্কলার আব্দুর রহমান বিন আবু বকর সুয়ুতি (লেখক 'তাদরিব আর রাওয়ি' ১৩৭৯সাল) ও ইবনে হাজার ( লেখক 'হায়দাল-সারি' ১৩৮৩সাল) এবং বিংশ শতাব্দির পাক ভারত উপমহাদেশের সাইয়িদ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ও মিশরের মুহাম্মদ তৌফিক সিদকির ("al-Islam huwa ul-Qur'an Wahdahu" "Islam is the Qur'an Alone"১৯২০) লেখা পাওয়া যায়। এরা সকলেই হাদীস বিরোধী ও সমালোচক ছিলেন।
বর্তমানে পাকভারতের গুলাম মুহাম্মদ পারভেজ , ডাঃ শাব্বির , মিশরের রাশাদ খালিফা , আহম্মদ মনসুর , তুরষ্কের এডিপ ইয়ুকসেল হাদীস বিরোধী লেখা ও সমালোচনার জন্য অবদান রেখেছেন।